Purchase!

চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার

খুব সহজেই বলা যায়, যে সময় নাসরীন জাহান এ উপন্যাস লিখছেন তখন দুনিয়াব্যাপী জাদুবাস্তবতার একটা ঘোর চলছে। তার হাওয়া বাংলা ভাষাতেও এসেছে। কেউ কেউ পন্ডিতি করছেন, কেউ কেউ লিখছেন ম্যাজিক রিয়ালিজমের কথা। শহীদুল জহীরকে সংজ্ঞায়িত করে ফেলা হচ্ছে বাংলার জাদুবাস্তবের প্রতিভ‚ হিসেবে। এইসব কিছুর আঁচ কি ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ পড়তে গেলে টের পাই আমি? পাই। কিন্তু সে আঁচ খুব বেশি দূর টেকে না।
By নাসরীন জাহান
Category: উপন্যাস
Paperback
Ebook
Buy from other retailers
About চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার
চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার পাঠের আগে
বন্ধু আবিদ এ আজাদ প্রকাশক। ঠিক ব্যবসায়ী নয়, প্রথাগত প্রকাশকদের মতো বইকে টাকার অঙ্কে গোনে না। আবার যে খুব সাহিত্যপ্রেমী, তাও নয়। তবে বই, বইয়ের নকশা নির্মাণে তার বড় মনোযোগ। তার ‘ক্রিয়েটিভ ঢাকা পাবলিকেশন্স’—এর পাণ্ডুলিপিগুলো সচরাচর আমিই নির্বাচন করি, বিনা পয়সার কনসালট্যান্ট আর কি!

তো তাকে বললাম, নাসরীন জাহানের একটা বই করব আমরা। পুরনো বই। কিন্তু বই কি পুরনো হয়? মানে প্রকাশনাটা পুরনো, কিন্তু বইটা নতুন করে ছাপব। মানে ক্রিয়েটিভ ঢাকা সংস্করণ। সে বলল, ওকে ডান। তারপর সবিনয়ে জানতে চাইল, “নাসরীন জাহানের ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ কেমন?”

আমি তার ভাষাতেই বললাম, ‘সে এক অভিনব উপাখ্যান।’ আরেকটু বিস্তৃত করে বললাম, ‘আসমানে মেঘ, অথচ রৌদ্রে আলোকিত নদী’ এমনই রহসম্যয় এক উপন্যাসের নাম ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’। এক এক অদ্ভুত, অচেনা নারীর উপাখ্যান। আমার বন্ধু আজাদ জাদুবাস্তবতা বোঝে না, ফ্যান্টাসি বোঝে না, লিজেন্ড, পুরাণ, উপাখ্যানও বোঝে না। সাহিত্যের মারপঁ্যাচ তার কম জানা। তাকে পেনসিলে দাগানো অংশ থেকে পড়ে শোনালাম, ‘তার নাম চন্দ্রলেখা। কথিত আছে নদী থেকে তার জন্ম। সে এক বিচিত্র উপাখ্যান। কাঠের পাটাতনের ওপর ভাসছিল তার দেহ। কাঠের কী মহিমা গর্জনরত জলও তার নিঃশ্বাস স্পর্শ করতে পারেনি। এ কাহিনী সবাই জানে। সবাই জানে, জলে ভেসে আসা চন্দ্রলেখা মানুষের চেয়েও বড় কিছু। সব ধর্মের লোকই তার কপালে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে পায় প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্মের রাজটিকা চন্দ্রলেখার কপালে জ্বলজ্বল করছে।’

সে আমাকে বলল, ‘বস, এ তো অন্য জিনিস!’

আজাদ কোনো কিছুকে খুব বড় করে দেখলে বলে, ‘সেই লেভেলের হইছে’ আর কোনো কিছু বুঝতে না পারলে বলে, ‘এ তো অন্য জিনিস!’ আমার মনে হয়, সাহিত্যের বোদ্ধা পাঠকদের চেয়ে আবিদ এ আজাদ একটা জায়গায় বড়, তার ভেতরে এখনো বিস্ময় আছে, এখনো তেমন লেখা পড়লে, না বুঝলেও, অন্য জিনিস যে সেটুকু বোঝে। লঙ্গিনাস তার সাহিত্যতত্ত্বে যে লফটিনেস, সাবলিমিটির কথা তুলে ধরেছেন তা তো আদতে সেই উচ্চতা, যাকে মাপা যায় না। উচ্চতা মাপা যায় না, তবে এটা যে সুউচ্চ, এর মহত্ত্ব যে বোধের অতীত এটুকুই তো সাবলিমিটি কিংবা পরম বিশুদ্ধতার আদি কথা। সেই আদি কথা ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’—এ আছে।

খুব সহজেই বলা যায়, যে সময় নাসরীন জাহান এ উপন্যাস লিখছেন তখন দুনিয়াব্যাপী জাদুবাস্তবতার একটা ঘোর চলছে। তার হাওয়া বাংলা ভাষাতেও এসেছে। কেউ কেউ পণ্ডিতি করছেন, কেউ কেউ লিখছেন ম্যাজিক রিয়ালিজমের কথা। শহীদুল জহীরকে সংজ্ঞায়িত করে ফেলা হচ্ছে বাংলার জাদুবাস্তবের প্রতিভূ হিসেবে। এইসব কিছুর আঁচ কি ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ পড়তে গেলে টের পাই আমি? পাই। কিন্তু সে আঁচ খুব বেশি দূর টেকে না। কারণ ল্যাটিন ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে আমাদের বাংলার লোকপুরাণ, সংস্কার, কিংবদন্তি কম পুরনো তো নয়। ‘তখন পূর্বজন্মের নানা ফিরিস্তি দিয়ে যাচ্ছে সে, বলছে, তার জন্মের সময় যখন কলেরায় শত শত লোক মরছে... শুধু মৃত্যু, কঙ্কাল, সে কী বিভীষিকাময় পরিস্থিতি, তখন চন্দ্রলেখার বাড়িতেও সেই রোগ এলো। পিতা মরল, মাতা মরল। চন্দ্রলেখার দিকে যখন সেই মৃত্যু যম—হাত বাড়াবে, তখন এক শিশুসাপ চন্দ্রলেখার শরীর বেষ্টন করেছিল। যমের ছোবল গিয়ে পড়েছিল সাপটার ওপরই। মৃত্যুর বিনিময়ে সাপ তাকে প্রাণ দিয়েছিল। এই কাহিনী প্রবাহিত ছিল বহু দূর গাঁ পর্যন্ত। মৃত্যুর পর জলের তলায় চন্দ্রলেখার যার সাথে প্রথম পরিচয় হয়, সেই ওই গোখরো। সেই গোখরো এখন চন্দ্রলেখার সর্বক্ষণের সহচর।’ এই সাপের বয়ান, এই গোখরা উপাখ্যান, এই কলোর বিভীষিকা, এই পুরাণ কিংবা লোককাহিনীর শরীরে বাংলার জন্মান্তরের ঘ্রাণ বিদ্যমান। মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’র কথা মনে হলেও মনে হতে পারে কারো, কিন্তু আমাদের কলেরার মহামাড়ি, ওলাওঠা দেবী খুব তো অচেনা আলাপ নয়। আমাদের বাবা—দাদাদের কাছেই তো কলেরায় গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়া কিংবা গোখরা সাপের সান্নিধ্যে বেড়া ওঠা নাগিনীকন্যার গল্প—কল্প শুনেছি। তাহলে নাসরীন জাহানের এই জাদুবিস্তারকে যদি এ মাটিরই ফসল বলি, খুব কি অন্যায় হবে? ‘সে জানায়, চন্দ্রলেখার জন্মটাই একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। ছ’ মাসে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল বলে স্বপ্নে দেখা দরবেশের নির্দেশে তাকে কয়েক মাস নদীর জলে কাঠের ওপর ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। অদৃশ্য জিনেরা চন্দ্রলেখার রক্ষণাবেক্ষণ করত।’

নিকটবর্তী লোক পুরাণ আমাদের ভাটি অঞ্চলে আছে তো! কাজেই ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ আমাদের লোকজ সংস্কৃতির অংশ আগে। আর করণ—কৌশলে, বরাবরই নাসরীন জাহান আধুনিক। নিজেকে তিনি ভাঙতে জানেন। এক উপন্যাস থেকে আরেক উপন্যাসে ক্রমশ একটা ভাঙনের মধ্য দিয়েই নিজেকে আবিষ্কার—নির্মাণ আর বিনির্মাণ করেন তিনি, যেমন করে থাকেন মহৎ লেখকেরা।

তবে আমার বিবেচনায় ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ কেবল একটি আখ্যান বা উপাখ্যান নয়। এটি একটি রাজনৈতিক দলিল, ঐতিহাসিক তথ্যচিত্রও বটে। একটা বৃহৎ অংশই পড়া যাক

‘তখন বাংলাদেশে ঘোর দুর্দিন। বন্যার করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসার পর পুরো দেশের ডায়রিয়া পরিস্থিতি মারাত্মক। পোকামাকড়ের মতো মানুষ মরছে। এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা এবং শাস্তির মেয়াদ ক্রমেই বাড়ছে। গ্রামে বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা এবং ডায়রিয়াজনিত কারণে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাড়ছে শিশুমৃত্যুর হার। বাজারে চালের মূল্য কম। যেহেতু বাঙালি বাঁচে ভাতের ওপর, সেহেতু বিষয়টি অত্যন্ত সুখের হতে পারত; কিন্তু কৃষক তার প্রাপ্য মূল্যের কিয়দংশও পাচ্ছে না। ফলে সাধের ফসল নদীতে নিক্ষেপ করে কেউ আহাজারি—চিৎকারে বাতাস আর্দ্র করে তুলছে, কেউ করছে আত্মহত্যা।

ভার্সিটির ছেলেদের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে ছিনতাইপ্রবণতা।

হাসিনা বলছে, খালেদা স্বৈরাচারেরই আরেক রূপ।

খালেদা বলছে, শুধু প্রতিবাদের জন্য প্রতিবাদ করাই হাসিনার স্বভাব।’

এইখানে এসে আমাদের কাছে চন্দ্রলেখার গল্প চেনা ভূগোল পেয়ে যায়। সামরিক শাসন, শোষণ, গণতন্ত্রের ফাঁকি আর অর্থনীতি শুভঙ্করের ফাঁকিও উঁকি দেয় এ উপন্যাসে। অথচ এই উপন্যাসই আবার কখনো ‘হীরক রাজার দেশ’—এ নিয়ে যায় আমাদের।

‘অত্যাচারী রাজার শাসন পদ্ধতির মূল পুঁজি ছিল জনগণকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। এই অঞ্চলের শাসনভার পাওয়ার পর সে নিজের প্রধান পেশা হিসেবে গাঁজার ব্যবসাকে গ্রহণ করেছিল। সাহায্যের প্রত্যাশায় বহির্বিশ্বের সামনে এ অঞ্চলের কঙ্কালসার মানুষ প্রদর্শন করত সে। তার এই মিশন ছিল অত্যন্ত সফল। ধনসমৃদ্ধ রাজ্য থেকে প্রচুর সাহায্য আসত। সেসব উদরস্থ করে দারুণ ফুলে—ফেঁপে উঠছিল সে। অন্যদিকে রমরমা গাঁজার ব্যবসা তো ছিলই।’

আজকের দিনে এসব পড়তে গিয়ে গাঁজার জায়গায় ‘ইয়াবা’ বসিয়ে দিলে কেমন হয়? আমার মনে পড়ে যায় যুগে যুগে সফোক্লিসের ইলেকট্রা হয়ে ওঠে ইউজিন ও নীলের ‘মর্নিং বিকামস ইলেকট্রা’ কিংবা বুদ্ধদেব বসুর ‘কলকাতার ইলেকট্রা’। যুগে যুগে টেক্সট তো তার অর্থ পাল্টায়। রল্যা বাঁর্থ যখন ‘লেখকের মৃত্যু’ ঘোষণা করেন, তখনই তো লেখা জীবিত হতে থাকে। বার্থের বয়ানে বুঝতে পারি লেখা বই আকারে প্রকাশের পর লেখকের আর কিচ্ছু বলার থাকে না, সে যেন মৃত, এবার যা বলে তা পাঠক কিংবা সমালোচক বলে। অর্থাৎ পাঠকের জন্ম হয়, আর লেখা স্বয়ং অমরত্বের দিকে যেতে থাকে নয়া নয়া ব্যাখ্যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, খুব সরল করে নাসরীন জাহানের ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ নামের ছোট্ট উপন্যাস কিংবা ঔপন্যাসিকা কিংবা উপাখ্যানের ব্যাখ্যা দেওয়া যথেষ্ট কঠিন হবে। কারণ নাসরীন জাহান একটু পরপরই কাহিনীর বাঁক বদলান। এ দেশের নদীর মতোই, সর্পিল গতিতে চলে তার কাহিনী বর্ণনা

‘চন্দ্রলেখার ওষ্ঠ রহস্যে স্ফুরিত, রাজার চরিত্রে সর্প এবং ওঝা দুইয়ের অবস্থানই থাকা আবশ্যক। এই বৃদ্ধ জানল এবং এই জনপ্রিয় বৃদ্ধের মধ্য দিয়ে জনতা অবগত হলো, রানী সম্পর্কে বাইরের গুঞ্জন সব ক্ষেত্রে সত্য নয়। বৃদ্ধকে উলঙ্গ করে প্রদর্শন করা হবে, এই গুজব নির্ঘাত প্রতিপক্ষের শত্রুরা ছড়িয়েছেÑএখন এই বিশ্বাসই জনতার মধ্যে বদ্ধমূল হবে।

তাহলে কি আমরা বৃদ্ধকে ব্যবহার করব না?

অপেক্ষা কর, সে এখন স্বইচ্ছায় ব্যবহৃত হতে আসবে।’

চন্দ্রলেখার সুকৌশলী রাজ্য পরিচালনায় একজন শতোর্ধ্ব বৃদ্ধও ব্যবহৃত হয়। রাজনীতির নতুন খেল শুরু হয়ে যায়। সকল ধর্মকে ব্যবহার করে চন্দ্রলেখা। এই চন্দ্রলেখা কে?

আমরা সঠিক উত্তর জানি না কিংবা প্রশ্নটা যত সহজ উত্তর তত সহজ নয়। ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ বাংলা সাহিত্যের অতি জটিল এক উপন্যাস। গল্পে, বিষয়ে, বয়ান ভঙ্গিতে, নির্মাণ কৌশলে এ উপন্যাস দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু একটি উপন্যাসের পূর্বপাঠে কতটুকু বলেই বা পাঠককে ধরে রাখা যায়। অতএব আমার বয়ান শেষ করি, চন্দ্রলেখার বয়ানের দিকে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই। শুধু শেষ একটু উদ্ধৃতি দিই

‘এদিকে আসমানের বিশাল কড়াইয়ে তখন মুড়ির মতো তারা ফুটতে শুরু করেছে। নিচে গুঁড়ি গুঁড়ি বালুর মতো কুয়াশা। মেঘখণ্ডের ফোকর গলিয়ে চাঁদবুড়ির এক চক্ষু দেখা যায়। স্তব্ধ হয়ে উঠেছে চারপাশ। অন্ধকার বৃক্ষের সাথে একাকার সেই একশো বিশ বছরের বৃদ্ধের দেহ কাঠ হয়ে আসতে থাকে।’

এই উদ্ধৃতির সূত্র ধরে যদি বলি চন্দ্রলেখা এক কাব্যিক উপন্যাস তাতেও কি খুব ভুল বলা হবে? নাসরীন জাহান কী অদ্ভুত কাব্যময় ভাষা আর আবহ তৈরি করেছেন, কী অধিবাস্তব, আধিভৌতিক, পরাবাস্তব কিংবা জাদুবাস্তব কিংবা লোকজ কিংবা পুরাণকল্প কাহিনীর দিকে আমাদের ঠেলে দেন, প্রিয় পাঠক, খেয়াল করুন। সাবধানে প্রবেশ করুন, ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ বয়ানে।

ইতি
মুম রহমান
Creative Dhaka
  • Copyright © 2024
  • Privacy Policy Terms of Use